বৃহস্পতিবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং

মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং

                        শঙখ শুভ্র নায়ক







রাত প্রায় ন'টা বাজে। পার্কের পিছনে একটা গাছ তলায় বসে অপেক্ষা করছিল হৃদয়। আকাশটা নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে আছে। গাছে গাছে হুটোপুটি শুরু করেছে কয়েকটা বাদুড়। একটা প্যাঁচা গাছের উপরে বসে আদিম হিংস্রতায় চিৎকার করে চলেছে। মেঠো ইঁদুরের বিষন্ন চ্যাঁচ্যাঁ শব্দ মাঝেমাঝেই বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। আজ এখানেই অঙ্কিতার আসার কথা। টোপটা সে ভালই দিয়েছে। ওয়ান নাইট পাঁচ হাজার টাকা। দু'হাজার টাকা একাউন্টে অনলাইন পেমেন্ট করেছিল, কাজের পর বাকি তিন। পকেট থেকে ছুরিটা বার করল হৃদয়। মোবাইলের আলোয় ছুরিটা একবার ঝলসে উঠল।
ওর মেসমেট জয়ন্তও জানেনা আজ সে কি করতে চলেছে। সে শুধু জয়ন্তকে বলেছিল সে নিজের চোখে সবটা দেখতে চায়। জয়ন্ত বার বার মানা করেছিল। বলেছিল, "দেখলে তুই সহ্য করতে পারবিনা।"
ঘটনাটা তিনদিন আগের। পড়াশুনার সূত্রে শহরের একটা মেসে থাকে হৃদয়। জয়ন্ত ওর মেসের বন্ধু। শিপ্রা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে সে। কিন্তু গত একমাস ধরে শিপ্রা জয়ন্তকে এভয়েড করছিল। আগের মতো আর ওর কাছে আসতে চাইছিলনা। বার বার রিকুয়েস্ট করছিল জয়ন্ত। কিন্তু শিপ্রা নাছোড়। কোনো না কোনো কারন দেখিয়ে জয়ন্তকে এড়িয়ে যাচ্ছিল সে, শেষে রাগ করে জয়ন্ত বলেছিল, "আমি আর এই শারীরিক কষ্ট সহ্য করতে পারছিনা, তুমি না এলে আমি কিন্তু গ্রিন প্লাজাতে চলে যাব।"
শিপ্রা বলেছিল, "যেখানে খুশি যাও, আমি এই মুহূর্তে তোমার লোড নিতে পারবনা।"
রাগ করে গ্রিন প্লাজাতে চলেও গিয়েছিল জয়ন্ত। গ্রিন প্লাজা এই শহরের নামি হোটেল গুলোর মধ্যে একটা। শহরের বড়োবড়ো মেসের গ্ল্যামারাস মেয়েরা ওই হোটেলে আসে। চড়া টাকার বিনিময়ে রাত কাটায়। গ্রিনপ্লাজা খুব পরিচিত নাম, কিন্তু পিছনে পলিটিকাল পাওয়ার থাকায় এই প্রস্টিটিউশন রমরমা ভাবে চলছে।
রাতে থমথমে মুখে ফিরেছিল জয়ন্ত। ওর কাছে এক্সপিরিয়েন্স শোনার জন্য উদগ্রীব হয়েছিল হৃদয়, কিন্তু জয়ন্ত ওকে এড়িয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করলে বলেছিল, "কিছু হয়নি।"
সেদিন থেকে হৃদয়ের মনটা খচখচ করছে। এই 'কিছু হয়নি'র মধ্যে কিছু হওয়া তো আছেই। জয়ন্তকে বার বার চাপ দিয়ে কথাটা আদায় করার চেষ্টা করেছিল হৃদয়। অবশেষে জয়ন্ত বলেছিল, "ওখানে গিয়ে আমি যাকে দেখেছিলাম তার নাম শুনলে তুই সহ্য করতে পারবিনা। প্লিজ, ইগনোর ইট।"
হৃদয় বলেছিল, "কে সে নাম টা বল?"
জয়ন্ত বলেছিল, "প্লিজ জানতে চাসনা, আমি বলতে পারবনা, আমি ওকে কথা দিয়েছি, তোর কাছে ওর নাম কখনোই বলবনা।"
হৃদয়ের বুকের ভিতরটা ধক করে উঠেছিল। বলেছিল, "আমার খুব পরিচিত কি?"
জয়ন্ত বলেছিল, "হ্যাঁ, তোর খুব ক্লোজ কেউ।"
হৃদয়ের বুঝতে বাকি ছিলনা মেয়েটা কে? অঙ্কিতা ওকে এভাবে ধোকা দেবে সে একবারও ভাবেনি। এই জন্য মাঝেমাঝে রাতে অঙ্কিতার ফোন সুইচ অফ পায়। জিজ্ঞেস করলে বলে পড়াশুনা করছি। এই তবে ওর পড়াশুনা? ছি! এতটা নিচে নেমে গেছে সে? গরীব বাড়ির মেয়ে হলেই কি এসব করতে হবে? হৃদয় তো চেয়েছিল ওকে সাহায্য করতে, নিলনা কেন? এরকম ভাবে টাকা ইনকাম করার চেয়ে তো অনেক বেশি সম্মানের হত সেটা?
অঙ্কিতার সঙ্গে ওর পরিচয় ওর খুড়তুতো বোন দীপালির সূত্র ধরে। একদিন অঙ্কিতাকে নিয়ে হৃদয়ের মেসে এসেছিল দীপালি। তখনই ওকে দেখে ওর পছন্দ হয়। তারপর দীপালির সাহায্যে দু'জনের মধ্যে প্রেম। দীপালিও ওকে অঙ্কিতার ব্যাপারে কিছু জানায়নি। ও যে এতটা নিচে নেমে গেছে, সেকথা একবার অন্তত বলতে পারত। হয়তো ভেবেছিল দাদা কষ্ট পাবে, কিম্বা জয়ন্তর মতো ওকেও হয়তো রিকুয়েস্ট করেছে অঙ্কিতা।
অঙ্কিতাকে এর আগে বেশ কয়েকবার সন্দেহ করেছে হৃদয়। ফোনে বেশ কয়েকবার ব্যস্ত পেয়েছে। জিজ্ঞেস করলে কখনো বলেছে বাড়ির ফোন আবার কখনো কোনো বান্ধবীর নাম বলে এড়িয়ে গেছে। কিন্তু সেদিনের ঘটনাটা সবচেয়ে মারাত্মক ছিল। একটা বই কিনতে গ্রিনপ্লাজার কাছের একটা দোকানে গিয়েছিল হৃদয়, ফিরে আসার সময় অঙ্কিতার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। গ্রিনপ্লাজা থেকে বেরিয়ে আসছিল সে। ওকে দেখে ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। হৃদয় জিজ্ঞেস করেছিল তুমি ওখানে কি করছিলে? অঙ্কিতা বলতে চায়নি। মারাত্মক ঝগড়া হয়েছিল সেদিন অঙ্কিতার সঙ্গে। অবশেষে আত্মপক্ষ সমর্থনে অঙ্কিতা বলেছিল একটা বান্ধবী ওকে জোর করে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল, সে জানতনা ওই জায়গাটা এরকম। অঙ্কিতা যে মিথ্যে বলছে সেকথা বুঝতে পেরেছিল হৃদয় তবু অঙ্কিতাকে সে বিশ্বাস করেছিল। আর সেই বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিল অঙ্কিতা?
পায়ের উপর দিয়ে সরসর করে কিছু একটা পেরিয়ে যেতে চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল হৃদয়ের। ওর সাইলেন্ট মোডে থাকা মোবাইলের স্ক্রিন লাইটটা জ্বলছে। অঙ্কিতার নাম্বার থেকে ফোন আসছে ওর নতুন নাম্বারে। হয়তো অঙ্কিতা জানতে চাইছে সে পৌঁছেছে কীনা। এই নাম্বারটা অঙ্কিতার পুরানো নাম্বার। হৃদয়ই ওকে নাম্বারটা দিয়েছিল, তারপর একদিন হুট করে নাম্বারটাকে সুইচ অফ করে দিল অঙ্কিতা। জিজ্ঞেস করতে বলল, "নাম্বারটা একজনকে দিয়েছি।"
তারমানে এইসব নোঙরা কাজের জন্য এই নাম্বারটা ব্যবহার করে অঙ্কিতা। ছি! ঘৃনায় গা ঘিনঘিন করে উঠল হৃদয়ের। কাল থেকে অঙ্কিতা ফোন করেনি হৃদয়কে, হয়তো অন্য কাস্টমারের সঙ্গে বিজি ছিল আর আজকের কাস্টমার তো স্বয়ং সে। মদের নেশাটা চাগাড় দিয়ে ধীরেধীরে মাথায় চড়ছে, নাহলে হয়তো রাগে এতক্ষণ ফোন টাকেই ভেঙ্গে ফেলত।
রিং বেজে বেজে ফোনটা কেটে গেল। ফোন ধরবেনা হৃদয়। ওর গলা শুনলে অঙ্কিতা ওকে চিনে ফেলতে পারে। মেসেজ করল, "আমি ওখানেই আছি। শব্দ করতে চাইনা, কে কোথায় সন্দেহ করবে, তাই ফোন ধরলামনা।"
অঙ্কিতা রিপ্লাই দিল, "আমি তোমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।"
গাছ তলায় বসে হৃদয় দেখতে পেল মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে মাঠটার দিকে কেউ একটা এগিয়ে আসছে। মুখ দেখতে পাচ্ছেনা, তবে চলার স্টাইলটা ওর খুব চেনা। মেসেজ করল, "মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে তুমিই কি আসছ?"
অঙ্কিতা রিপ্লাই দিল, "হ্যাঁ।"
এখান থেকে ধীরেধীরে হাঁটলে অঙ্কিতার কাছে পৌঁছে যাবে হৃদয়। ওর ঠিক পিছনে। আকাশে চাঁদ নেই, ঘুটঘুটে অন্ধকার, তাই অঙ্কিতা টের পাবেনা, সে কে। মেসেজ করে বলল, "লাইট বন্ধ করে তুমি ওখানেই দাঁড়াও, আমি তোমার কাছে আসছি।"
"আচ্ছা," রিপ্লাই দিয়ে অঙ্কিতা দাঁড়িয়ে পড়ল। পা টিপেটিপে অনুমান করে ধীরেধীরে অঙ্কিতার পিছনে এসে পৌঁছাল হৃদয়। এই তো বেশ টের পাচ্ছে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা নারী অবয়ব। গায়ের গন্ধটাও খুব চেনা। আস্তে আস্তে অঙ্কিতার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল হৃদয়। মনেমনে বলল, "তোমার খেলা শেষ অঙ্কিতা।" ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল হৃদয়। সরল বিশ্বাসে হৃদয়ের গায়ে গা এলিয়ে দিল অঙ্কিতা। হৃদয় ওর বাম হাতটাকে অঙ্কিতার বুকের উপরে রাখল, তারপর ধীরেধীরে হাতটাকে তুলে আনল মুখের কাছে। ডান হাতদিয়ে পকেট থেকে ছুরিটা বার করল সে। বাম হাতে অঙ্কিতার মুখটা চেপে ধরে হঠাৎই ছুরিটা চালিয়ে দিল অঙ্কিতার গলার উপরে। "ওঁক" করে একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল অঙ্কিতার মুখ দিয়ে। গলা দিয়ে ফিনকি দিয়ে একটা তরল পদার্থ বেরিয়ে এসে হৃদয়ের হাতটা ভিজিয়ে দিল। বলি হওয়া পাঠার মতো অঙ্কিতার শরীরটা কয়েকবার কেঁপে উঠল, তারপর শিথীল হয়ে গেল।
ধীরেধীরে অঙ্কিতাকে মাঠের উপরে শোয়াল হৃদয়। না ওর মুখ সে দেখতে চায়না। এই মৃত মুখটাকে দেখার কোনো ইচ্ছেই ওর নেই। সে মাঠ থেকে মেসের দিকে হাঁটতে লাগল। কাল সকালে হয়তো ওর কাছে পুলিশ আসবে, জিজ্ঞাসাবাদ করবে, না কোনো কথাই লুকোবেনা হৃদয়। ভরা আদালতে জোর গলায় বলবে কেন সে অঙ্কিতাকে খুন করল। কতটা নোঙরামি সে ওর সঙ্গে করেছিল। তাতে আদালত ওকে যা সাজা দেবে সে মাথা পেতে নেবে। কিন্তু এরপর থেকে কোনো মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডকে এভাবে ধোকা দেওয়ার আগে একবার অন্তত অঙ্কিতার কথা ভাববে, এটা ভেবে একবার অন্তত শিউরে উঠবে যে তারও অঙ্কিতার মতো পরিণতি হতে পারে।
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই ফিরছিল হৃদয়। বড়ো রাস্তায় ওঠার আগেই হঠাৎ ওর মোবাইলের স্ক্রিনলাইট টা জ্বলে উঠল। ওর মোবাইলে ফোন ঢুকছে। অঙ্কিতার অরিজিনাল নাম্বার থেকে ফোন ঢুকছে। বুকের ভিতরটা হিম হয়ে গেল হৃদয়ের। ধীরেধীরে ফোনটা একসেপ্ট করে 'হ্যালো' বলতেই ওপাশ থেকে অঙ্কিতা বলল, "হ্যালো, কি করছ?"
ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। অঙ্কিতা এখোনো বেঁচে আছে! সে ভুতে বিশ্বাস করেনা, নাহলে হয়তো ভুতে ফোন করছে বলে ধরে নিত। তবে? সে যাকে খুন করল সে কে? অঙ্কিতা কি ওর জায়গায় অন্যকোনো মেয়েকে পাঠিয়েছিল? ছুটে লাশটার কাছে এগিয়ে গেল হৃদয়। মোবাইলের স্ক্রিন লাইটটা ধীরে ধীরে লাশটার মুখের উপরে ফেলল। আর তার পরেই ভিমরি খেয়ে মাটিতে বসে পড়ল। ছুরিটাকে নিজের গলায় চালিয়ে নিতে ইচ্ছে করল হৃদয়ের। ভুল করে সে এ কি করে ফেলল? অঙ্কিতা আজ পর্যন্ত একটিও মিথ্যে কথা বলেনি, মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং টা হয়েছে ওরই। হয়তো এজন্যই জয়ন্ত মেয়েটার নাম ওর কাছে বলতে চায়নি। মৃত্যু যন্ত্রনায় বিকৃত এই মুখটা ওর ভীষণ চেনা। মেয়েটা ওর ভীষণ পরিচিত একজন। লাশটা আর কারুর নয় ওর খুড়তুতো বোন দীপালির।
(সমাপ্ত)
©All rights reserved to sankha subhra nayak


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন