রবিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

কো-ইন্সিডেন্ট

কো-ইন্সিডেন্ট

শঙখ শুভ্র নায়ক



গত কয়েকদিন ধরে স্ত্রীর প্রতি আমার অবিশ্বাস ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। সেদিন অফিস থেকে ফিরে আমি দরজা খুলতে যাব হঠাৎ শুনতে পেলাম সে ভিতরে কারু সঙ্গে কথা বলছে। দরজা খুলতেই দেখলাম সে তাড়াহুড়ো করে কানে ফোনটা নিয়ে বলল, "আচ্ছা সোমা, এখন রাখছি পরে কথা হবে।"

আর একদিন গাড়িতে যেতে যেতে ও ফিসফিস করতে আরম্ভ করল। আমি যাতে শুনতে না পাই তেমনই মৃদু স্বরে। আমার সত্যিই সন্দেহ হচ্ছে। না, আমার স্ত্রী পরকীয়ার জড়িয়ে পড়েছে এমন সন্দেহ আমার নেই। সেটা হলেও আমার খুব দুঃখ ছিলনা। আমার সন্দেহ হচ্ছে ওর ফোনের উল্টো পাশে সত্যিই কেউ থাকে তো? নাকি ও কাল্পনিক কারুর সঙ্গে কথা বলে, যার অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে নেই।

আমি অভিক, অভিক বসু। বর্তমানে ইন্ডিয়ার মোস্ট ফেমাস অনলাইন ফিকশন রাইটারদের একজন। আমার লেখা প্রতিটা বই অন লাইনে যথেষ্ট বিজনেস করে। সেই হিসেবে আমার ফ্যান সংখ্যাও অজস্র। মেয়ে ফ্যানও আমার কম নেই। অনেকেই আমাকে ফোন করে কথা বলে। ফেসবুকে হোক কিম্বা হোয়াটস আপে অনেক মেয়েই আমাকে মেসেজ করে। মেসেজ ফেলে রাখার হ্যাবিট আমার নেই বলে মেসেজ রিপ্লাই করি। সেসব দেখলে ওর খারাপ লাগে বুঝতে পারি, কিন্তু ফ্যান ফলোয়িং ধরে রাখার স্বার্থে খারাপ ব্যবহার করা আমার চলেনা। যাইহোক রিসেন্ট তন্দ্রিমা নামে একটা মেয়ের সঙ্গে আমার একটু বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। এমন নয় যে ওর সঙ্গে আমার অন্য কিছু রিলেশন ছিল, কিন্তু ব্যবসায়ীক স্বার্থের কথা ভেবে আমাকে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে হয়েছে। সেটা নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরেই রুমকির সঙ্গে আমার একটু চাপা ঝগড়া চলছিল। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন রুমকিই আমার স্ত্রী। ওকে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেছি এসব ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে, কিন্তু যদি কেউ বুঝবনা বলে গোঁ ধরে বসে থাকে তাকে কিভাবে বোঝানো যাবে আমি জানিনা। সেদিন ওর সঙ্গে গাড়িতে করে একটা সেমিনার এটেন্ড করতে যাচ্ছিলাম। ইদানিং সন্দেহের জন্য রুমকি আমাকে কোথাও একা ছাড়তে চায়না, যেখানেই যাই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয়। যাওয়ার পথেই তন্দ্রিমার ফোন ঢুকল আমার মোবাইলে, তারপর রুমকি এমন ভাবে আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে শুরু করল যে ওকে থামানো গেলনা। মাঝ রাস্তায় আমার গাড়ির হ্যান্ডেল ধরে এমন একটা হ্যাঁচকা টান মারল যে গাড়িটা নিয়ন্ত্রন হারিয়ে সোজা গিয়ে একটা গাছে ধাক্কা মারল, আমার মাথা ফেটে গিয়েছিল কিন্তু চোট বেশি রুমকিই পেয়েছিল, তারপর থেকেই রুমকি কেমন বদলে গিয়েছে। আজ অফিস থেকে ফিরে দরজার সামনে আমি থমকে দাঁড়ালাম। শুনতে পেলাম ভিতরে রুমকি কাউকে বলছে, "নীল প্লিজ, বোঝার চেষ্টা করো আমি বিবাহিত। আমার পক্ষে তোমার সঙ্গে ওই সব সম্পর্ক করা সম্ভব নয়। তুমি আমার শরীর দেখতে চেয়েছিলে দেখিয়েছি, তার বেশি নয়, প্লিজ...!"

দরজায় টোকা দিয়ে আমি রুমে ঢুকলাম। বেশ কয়েকদিন রুমকি আমার উপরে সন্দেহ করে ঝগড়া করেনি, এতে আমি অনেকটাই শান্তিতে ছিলাম, কিন্তু ব্যাপারটা কিছুটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে দেখে আমি রাশ টানতে বাধ্য হলাম। রুমকিকে ডেকে বললাম, "তোমার কাছে পরিষ্কার ভাবে আমি একটা কথা জানতে চাই।"

রুমকি বলল, "হ্যা বলো?"

বললাম, "তুমি যার সঙ্গে সারাদিন কথা বলো সে কে?"

রুমকি অবাক হল, "আমি সারাদিন কথা বলি তুমি কিভাবে জানলে? তুমি কি আমার পিছনে ডিটেকটিভ লাগিয়েছো নাকি?"

বললাম, "যেভাবেই জানি, তুমি কিন্তু ভুল করছ রুমকি, খুব বড়ো ভুল।"

রুমকি অবাক হল, "তুমি অন্য মেয়ের সঙ্গে কথা বললে সেটা ভুল নয় আমি বললেই ভুল।"

বললাম, "সেটা নয় রুমকি। তুমি যদি ফোনে অন্য ছেলের সঙ্গে টাইম পাস করতে তাতে আমার এতটুকুও দুঃখ ছিলনা, কিন্তু তুমি যে কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছনা, আর এটা আমাকে লুকোবার চেষ্টা করছ, সেটা দেখেই খারাপ লাগছে।"

রুমকি চমকে উঠল, "তুমি কিভাবে জানলে আমি ফোনে কথা বলিনা? তুমি আমার রুমে স্পাইক্যাম লাগিয়েছ?"

বললাম, "হ্যাঁ লাগিয়েছি। লাগাতে বাধ্য হয়েছি, কারন আমার বেশ কয়েকদিন ধরেই সন্দেহ হচ্ছিল তুমি মেন্টাল ইলনেসে ভুগছ, দ্যাটস হোয়াই তোমার উপরে নজর রাখতে আমি বাধ্য হয়েছি।"

রুমকি রেগে গেল, "হোয়াট ডু ইউ মিন? আমি একটা পাগল? হাও দ্যা হেল আর ইউ। তুমি আমার উপরে স্পাই করছ, দেন আমাকেই উপদেশ দিচ্ছ।"

ঠান্ডা মাথায় বললাম, "দেখ রুমকি তুমি যেভাবে সারাদিন নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলো দ্যাট ইজ নট নর্মাল। তোমার এই মুহূর্তে একজন সাইকোলজিস্টের প্রয়োজন।"

রুমকি বলল, "আমি নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলিনা, আমি নীলের সঙ্গে কথা বলি। হি লাভস মি ভেরি মাচ।"

বললাম, "হাউ ইজ ইট পসিবল? কোনো ফোন ছাড়াই কিভাবে তুমি ওর সঙ্গে কথা বলো?"

রুমকি বলল, "আমার এক্সিডেন্ট হওয়ার পর থেকে আমি নীলের ব্রেনের সঙ্গে নিজের ব্রেনটাকে কানেক্ট করতে পারি, ওর কথা শুনতে পাই, ও কি করছে দেখতে পাই, এমনকি ওর কোনো কষ্ট হলে আমি সেটাও অনুভব করতে পারি, তাই ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য আমার কোনো ইনস্ট্রুমেন্টেরই দরকার হয়না।"

বললাম, "আচ্ছা, তোমার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তুমি এক্ষুনি ওর ফোন নাম্বার চাও। আমি দেখতে চাই নীল নামে কোনো ছেলের অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে আছে।"

রুমকি বলল, "তোমার সামনে বসে ওর সঙ্গে নিজের ব্রেনটাকে কানেক্ট করলে ও তোমাকেও দেখতে পাবে। তখন কথা বলতে চাইবে কীনা সন্দেহ আছে..."

বললাম, "আচ্ছা, আমি তাহলে পাশের রুমে থাকছি।"

আমি রুম থেকে বেরিয়ে পাশের রুমে চলে গেলাম। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলাম, "ডার্লিং নীল। তোমার ফোন নাম্বারটা দাও তো প্লিজ। আমি একবার ফোনে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই... কী বলছ? তোমার ফোন নাম্বার নেই?... ইজ ইট পসিবল? তোমার কোনো ফোনই নেই? না ডার্লিং, আমার মনেহচ্ছে তুমি লুকোচ্ছ... ও আচ্ছা, পড়াশুনার ক্ষতি হবে বলে তুমি ফোন রাখোনা... আচ্ছা, ঠিক আছে, তোমার সঙ্গে পরে কথা বলছি, আমার হাজবেন্ড বাথরুম থেকে আসছে..."

পাশের রুম থেকে বেরিয়ে আমি রুমকির কাছে এলাম। ওর পিঠে হাত রেখে বললাম, "প্লিজ সুইটহার্ট বোঝার চেষ্টা করো। ও তোমাকে ফোন নাম্বার দিতে পারলনা কারন তোমার নীল নামে কোনো প্রেমিকের অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে নেই, গোটাটাই তোমার অবচেতন মস্তিষ্কের কল্পনা মাত্র। আমার উপরে রাগ করে তুমি অন্য কারো সঙ্গে রিলেশন করলে আমার দুঃখ ছিলনা, কিন্তু তুমি এভাবে নিজের কল্পনার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিজের ক্ষতি করছ দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে।"

রুমকি মাথা নাড়ল। এই শকটার পরে ও অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছিল। আমিও যতটা সম্ভব ওর খেয়াল রাখার চেষ্টা করতাম, ওকেও দেখতাম আর নিজের সঙ্গে নিজে সেভাবে কথা বলতনা, কেবল মাঝে একবার কলকাতার একটা ঠিকানা দিয়ে বলেছিল এই ঠিকানায় নীল নামে কোনো ছেলে থাকে কীনা খোঁজ নিতে পারবে, কিন্তু রুমকি সুস্থ হয়ে উঠছে দেখে আমার আর ওই ঠিকানায় খোজ নেওয়ার মানষিকতা হয়নি।

সেদিন আমার বার্থ ডে ছিল। আমাদের শহরের বেশ কয়েকজন সম্মানীয় অতিথিকে নিমন্ত্রন করেছিলাম। আমাদের সার্কেলের সুপারিন্টেনডেন্ট অফ পুলিশও তাদের মধ্যে ছিলেন। কথার ফাঁকে হঠাৎ রুমকি উঠে বাথরুমে গেল। তার খানিকক্ষণ পরেই বাথরুমের ভিতর থেকে রুমকির ভীষন চিৎকারের শব্দ শুনতে পেলাম। বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে রুমকিকে যখন বার করেছিলাম, তখন ও প্রায় জ্ঞান হারিয়ে বিড়বিড় করছে, ওর কথার একটা শব্দই বুঝতে পেরেছিলাম 'ট্রাক আসছে'। হাস্পাতালে পৌঁছানোর আগেই রুমকি মারা গিয়েছিল। পোষ্ট মর্টেমের পর ডাক্তার বাবু বলেছিলেন, কোনো কিছু দেখে ভীষন আতঙ্কে ওর হার্ট ফেল করেছে। ওর মানষিক অসুস্থতা ছাড়া আতঙ্কের অন্য কোন কারন আমি বাথরুমের ভিতরে খুঁজে পাইনি।

অনেকদিন পরে একটা সেমিনার এটেন্ড করতে আমি কলকাতায় এলাম। আজ আমার সঙ্গে আর রুমকি নেই, তবে ওই দুঃসময়ের পরেও তন্দ্রিমা আমার হাত ছেড়ে দেয়নি, সে সেদিনও যেমন আমার বন্ধু ছিল আজো তাই আছে। সেমিনার শেষ করে হোটেলে ফেরার পথে হঠাৎ রুমকির দেওয়া ঠিকানাটা আমার মনেপড়ে গেল। তন্দ্রিমাকে নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে আমি ওই ঠিকানায় গিয়ে পৌঁছালাম। দরজায় কড়া নাড়তেই এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসে দরজা খুললেন। আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, "কাকে চাই?"

বললাম, "আচ্ছা এই ঠিকানায় নীল নামে কোনো ছেলে থাকে কি?"

ভদ্রলোক বেশ খানিকক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, "আপনারা ওর কে হন?"

বললাম, "কেউ হইনা, আসলে ওর সঙ্গে আমার একবার পরিচয় হয়েছিল, তখনই ওর কাছে এই ঠিকানাটা পেয়েছিলাম। ও কি আছে? ডেকে দিতে পারবেন একবার?"

ধীর গলায় ভদ্রলোক বললেন, "ওকে তো আর আপনারা পাবেন না।"

বললাম, "কেন? ও কি এখন এখান থেকে অন্য কোথাও চলে গেছে?"

মাথা নেড়ে ভদ্রলোক বললেন, "না। গত বছর উনত্রিশে ডিসেম্বর সন্ধ্যে ছ'টার সময় অন্যমনষ্ক ভাবে পথ চলতে গিয়ে ট্রাকের তলায় চাপা পড়ে সে মারা গেছে।"

কথাটা শুনে আমার গোটা শরীর শিউরে উঠল। রুমকির মৃত্যুর সময়টাও আমার স্পষ্ট মনে আছে, উনত্রিশে ডিসেম্বর, সন্ধ্যে ছ'টা।

(সমাপ্ত)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন